logo

এক চোখে হাসি, অন্য চোখে জল

  • December 10th, 2022
Suman Nama

এক চোখে হাসি, অন্য চোখে জল

সুমন চট্টোপাধ্যায়

নবনীতা দেব সেন নিজের কথা বলতে গিয়ে একদা লিখেছিলেন,’ আমি এক চোখে হাসি, অন্য চোখে কাঁদি।’ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা থেকে ভোর সাড়ে তিনটে, টানা আট ঘন্টা টেলিভিশনের সামনে গাঁজাখোরের মতো বুঁদ হয়ে বসে থাকার পরে, রিমোটের অফ বাটনটি টিপে বিছানায় ক্লান্ত শরীরটি এলিয়ে দেওয়ার সময় আমারও দেখি একই অবস্থা। বাঁ চোখে নেইমারের জন্য অশ্রুজল, ডান চোখে মেসির জন্য হাসি!

ফুটবলেশ্বরের সন্তান যারা তারা সারাক্ষণ মাঠে থাকে প্রতিপক্ষের হৃদকম্প বাড়ানোর জন্য, কিন্তু ম্যাজিক দেখায় বড় জোর দু’চারবার, এমন মুহূর্তের ইন্দ্রজাল তাদের জাত চেনায়, প্রতিদ্বন্দ্বীকে হতচকিত করে সব অঙ্ক এলোমেলো করে দেয়, অনেক সময় এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলিই হয়ে ওঠে ম্যাচের নির্নায়ক।ফুটবল রসিকের মনশ্চক্ষে সেই মুহূর্তগুলি ভেসে থাকে সারাটা জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ঠাকুরমার ঝুলির গপ্পো হয়ে বেঁচে থাকে।

ব্রাজিল- ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে সেই স্বর্গীয় মুহূর্তটি এল একস্ট্রা টাইমে, ঠিক একশ পাঁচ মিনিটের মাথায়। পরপর দুই সতীর্থর সঙ্গে ওয়ান-টু, ওয়ান-টু পাসে এগোতে এগোতে হঠাৎ শরীরটাকে ধনুকের মতো ভাঁজ করে হরিণ-গতিতে ক্রোয়েশিয়ার পেনাল্টি বক্সে নেইমার এমন ভাঁজ মারলেন, সামনে গোলকিপার ছাড়া আর কেউ নেই। তারপর চোখের পলকে গতি স্তব্ধ করে দিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা মাথায় বলটা টপকে দিলেন গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে। নেইমার বুঝিয়ে দিলেন কেন তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার।

রেফারির শেষ বাঁশি বাজতে তখন আর মাত্রই পনেরো মিনিট, দোহার স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে সর্ষে ফুলের ক্ষেতে তখন মাতন লেগেছে, অবশেষে কোয়ার্টার ফাইনালের গেরো পার করে বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সেমিফাইনালে পৌঁছনর অধীর অপেক্ষায় দুনিয়া জুড়ে সাম্বা ভক্তের দল। ক্রোয়েশিয়ানদের বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে, চোয়াল নেমে গিয়েছে, পেরিসিচ মাটির ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, মার্সেলো ব্রোজোভিককে দেখা গেল এক সতীর্থের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে।আর ঠিক সেই সময়ই ঈশ্বর-প্রেরিত দূতের মতো উঠে এলেন এক অক্লান্ত ক্রোয়েশিয়ান,বয়সকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যিনি জীবনের চতুর্থ, সম্ভবত জীবনের শেষ বিশ্বকাপে দেশের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছেন।ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক, একবার গোল্ডেন বুট জেতা মরিদিচ।

ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে, আর মাত্র একশ আশি সেকেন্ড। বল এসে পড়ল মরিদিচের পায়ে। একবার চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে তিনি দেখতে পেলেন বাঁয়ে মিসলাভ অরিসিচ দাঁড়িয়ে, সম্পূর্ণ অরক্ষিত।বলটা পেয়ে অরিসিচ এমন দৌড় শুরু করলেন যেন উসেন বোল্ট, স্কোয়্যার পাসে বলটা পাঠালেন ব্রুনো পেটকোভিচের নাকের ডগায়, তিনি সর্বশক্তি দিয়ে গোলে শট নিলেন। ব্রাজিলের গোলকিপার যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন বলটা কোলে তুলে নিতে খুব অসুবিধে হোতনা। কপালের নাম গোপাল, বলটা মার্কউইনহোর শরীরে লেগে দিশা বদলে ফেলল, গোলকিপারের আর কিছুই করণীয় ছিলনা। বাকিটা ইতিহাস।

নব্বইয়ের দশকের পরে বিশ্ব ফুটবলের আকাশে উল্কার মতো উত্থান হয়েছে পূর্ব ইউরোপের এই একরত্তি দেশের।জনসংখ্যা বড় জোর কলকাতার তিনভাগের একভাগ। সাবেক যুগোশ্লোভাকিয়া ভেঙে যে সাতটি ছোট ছোট দেশ মাথাচাড়া দিয়েছে তারা সবাই ফুটবল খেলিয়ে, সার্বিয়া তো এবার মূল প্রতিযোগিতাতেও জায়গা পেয়েছিল, তবে সাতের মধ্যে ক্রোয়েশিয়াই বরাবর ফার্স্ট বয়। লাল-সাদা চৌখপ্পি মারা জার্সি পরা এই টাট্টু ঘোড়াগুলি যে কী বিষম বস্তু ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের বিশ্বকাপে লিওঁতে তা প্রথম টের পেয়েছিল ফুটবলের সুপার পাওয়ার জার্মানি। সেই ম্যাচে ভি আই পি গ্যালারিতে সেদিন আমিও ছিলাম।মনে হচ্ছিল সুকের বাহিনীর দাপটে বার্লিন ওয়াল ভাঙছে বারেবারে। দেশের এমন বেইজ্জতি চোখের সামনে সহ্য করতে না পেরে সেদিন খেলা শেষ হওয়ার আগেই বেকেনবাওয়ার, রুমেনিগেকে মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়তে দেখেছিলাম। ভি ভি আই পি বক্সে মধ্যমনি হয়ে বসে থাকা জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোলকে দেখেছিলাম, খেলার শেষে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের জল মুছছেন। কাল রাতে নেইমারকে মাঠে বসে কাঁদতে দেখে বারবার আমার মনে সেই স্মৃতিটুকু ভেসে উঠছিল। মাত্র বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যেই ক্রোয়েশিয়া প্রমাণ করে ছেড়েছে ‘ হাম কিসিসে কম নেহি!’ কিংবা জো হামসে টকরায়েগা ও চুরচুর হো জায়েগা। মস্কোর শেষ বিশ্বকাপে তো ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া, দোহায় যে কী হবে, আল্লা জানেন।

অথচ এই ক্রোয়েশিয়া দলে মরিদিচ ছাড়া বাকি ফুটবলাররা প্রায় কেউই ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলেননা, স্বদেশই তাঁদের ফুটবল জীবনের সীমানা। এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলির সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার মৌলিক পার্থক্যটা এখানেই। বছর কয়েক আগে সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়ে জাগ্রেবে কয়েকটি দিন কাটিয়েছিলাম। উপলব্ধি করেছিলাম ফুটবল আসলে ক্রোয়াট জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতীক, ফুটবল দিয়েই গোটা বিশ্বকে তারা নিজেদের উদ্ধত উপস্থিতি জানান দিতে চায়। সার্বিয়ানদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধের সূচনা, তাও হয়েছিল জাগ্রেবের স্টেডিয়ামেই। ইতিহাস আর জাত্যাভিমানের প্রেক্ষাপটটি মাথায় রাখলে তবেই বোঝা যায় ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল- সাফল্যের উৎসকথা। দলটার সাফল্যের বীজ পোঁতা আছে কেবল সেই দেশের মাটিতেই।

অতএব মেসির দুর্লভ হাসি, প্রাণভরা উচ্ছাস কত ঘন্টা স্থায়ী হয় কেউ বলতে পারেনা। ওলন্দাজদের বিরুদ্ধ দলে একজন লিওনেল মেসি না থাকলে তারাই উঠত সেমিফাইনালে। দু’গোলে পিছিয়ে থেকে যেভাবে বর্গীহানার মতো কমলা বাহিনী প্রত্যাঘাতের পর প্রত্যাঘাত এনে ম্যাচে সমতা ফেরাল তাও কম চোখ-ধাঁধানো নয়। আমার তো ভয় হচ্ছিল খেলা শেষের আগে আমার ডান চোখটাও না জলে ভরে ওঠে। একই রাতে দু’টো ম্যাচ, একটি যেন অন্যটির প্রত্যয়িত নকল। ব্রাজিল আর আর্জেন্তিনা প্রথমে গোল করে এগিয়ে থাকল, প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া আর নেদারল্যান্ডস সমতা ফিরিয়ে ম্যাচটাকে নিয়ে গেল টাই ব্রেকারে। সেখানে এসেই আটকে গেল ওলন্দাজদের বোমারু অভিযান, মেসির দলের সাফল্য পেলনা ব্রাজিল।

টাই-ব্রেকারে হারজিৎ খেলার মানের সূচক নয়, সবাই জানে, সবাই বোঝে।তবু ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয় স্কোর কার্ড, কীভাবে জয় এসেছে তা গৌন হয়ে যায়। এই ব্রাজিলই ১৯৯৪ সালে পাসাডেনার রোজ বোলে ইতালিকে টাই ব্রেকারে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল। ২৮ বছর পরে ফল হোল উল্টো। আমি ফুটবল বিশেষজ্ঞ নই, তবু কেন জানিনা মনে হচ্ছে দলের হয়ে প্রথম পেনাল্টিটা যেমন মেসি নিলেন, নেইমার সেকাজ করলেননা কেন? টাই ব্রেকার তো স্নায়ুর খেলা, প্রথম পেনাল্টির গুরুত্ব তাই সবচেয়ে বেশি। প্রথম চোটে ধাক্কা খেলে তা সামলে ওঠা খুবই মুশকিল। ব্রাজিলের পদত্যাগী কোচ তিতে কেন যে নেইমারকে প্রথম পেনাল্টি নিতে বললেননা, সেই জরুরি প্রশ্নটি নিয়ে এখন কাটাছেঁড়া চলবে অনেক, অনেক দিন।

2 comments

  1. শুনেছিলাম, সাংবাদিকদের আলাদা আলাদা কাজের জায়গা ভাগ করে দেওয়া হয়। তাকে বিট বলে। আরও শুনেছিলাম, আপনি রাজনৈতিক বিটে ছিলেন। তাই? বিশ্বাস হয় না, স‍্যর। আপনার খেলার বিশ্লেষণ বোধহয় ঐ খেলা জগতের যেকোনো সাংবাদিকের কলমকে হারিয়ে দিতে পারে, অবলীলায়।🙏 ভাল থাকবেন।

  2. লেখার গুণে কখন যেন ন্যারেটিভ , ‘ গদ্যকবিতা’ হয়ে যায় !!🙏

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *